জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিস্মরণবিরোধী ফেলিনি

সৈকত দে প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২, ১০:৫০ এএম বিস্মরণবিরোধী ফেলিনি

বিশ্ববিপ্লবের জন্য বিখ্যাত ১৯১৭ সালে আরেকটি অপূর্ব ঘটনা ঘটেছিলো যা কি না আমাদের অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। গাম্বেতোলার ক্ষুদ্র ভূস্বামী, কৃষক পরিবারের ছেলে উরবানো ফেলিনি, রোমান ক্যাথলিক বুর্জোয়া বণিক পরিবারের মেয়ে ইদা বারবিয়ানিকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন, পরিবার মেনে নেবে না বলে। ভাগ্যিস পালিয়েছিলেন! তাই আমরা ফেলিনিকে পেলাম। রিকোর্ডো আর মারিয়া মাদালেনা ফেলিনির দুই সহোদর সহোদরা। রিকার্ডো পরবর্তী জীবনে তথ্যচিত্র নির্মাতা আর ফেলিনির আত্মজীবনের খানিক স্পর্শখচিত চলচ্চিত্র 'আই ভিত্তেলিওনি'-তে তাঁকে অভিনয় করতে দেখা যাবে, তবে সেসব আরো অনেক পরের কথা। ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারিতে জন্মেছিলেন ফেদেরিকো ফেলিনি, এ বছর জন্মশত বর্ষ, করোনাকবলিত দুনিয়াতে শতবর্ষ পালনের জৌলুস কিছু কম, কিন্তু দিকে দিকে লেখাপত্র রচনায় করোনা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

১৯২৪ সালে সান ভিনচেনজোর নানদের পরিচালিত স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। দুই বছর বাদে কার্লো টন্নির পাবলিক স্কুলে ভর্তি। মনোযোগী ছাত্র, অবসর কাটাতেন ড্রইং করে, পুতুল নাচ মঞ্চস্থ করে। ইল করিরিয়েরে দেই পিকোলি নামের শিশু পত্রিকায় আমেরিকান কার্টুনিস্ট উইনসর ম্যাককে, জর্জ ম্যাকমানাস আর ফ্রেডারিক বার উপারের কাজকর্ম ভালোবাসতেন।  গ্র্যান্ড গুইগনলের সার্কাস দেখলেন এ সময়। গুইদো ব্রিগনোনের ‘মাচিস্তে অল ইনফের্নো’ ( মাচিস্তে ইন হেল), তাঁর দেখা প্রথম সিনেমা, পরবর্তী জীবনে প্রভাব রেখে গেছে। আগ্রহীরা ইউটিউবে দেখে নিতে  করতে পারেন। ১৯২৯ সালে জিন্নাসিও জুলিও সিজারে ভর্তি, পেলেন আজীবন বন্ধু লুইগি টিট্টা বেনজিকে, বেনজি পরবর্তী জীবনে রিমিনির বিখ্যাত আইনজীবী ( মনে থাকবে অনেকের, আমারকর্দের তরুণ তিত্তা চরিত্রের সূত্র এই বন্ধু)। দুই বন্ধুকেই বাধ্যতামূলকভাবে ফ্যাসিস্ট যুব সংগঠন আভানগুয়ারদিয়ারের সভ্য হতে হয়েছিলো। ১৯৩৩ সালে বাবামার সাথে প্রথম রোম দেখা (অভিজ্ঞতার খানিক ফিরে আসবে 'রোমা' সিনেমায় অনেকদিন পর)। পরের বছর এক ব্যাপক ঝড় হয়, রিমিনি সমুদ্রসৈকতে বিরাটাকৃতি মাছ ধরা পড়ে ( অতিবিখ্যাত ‘লা ডলচে ভিতা’ সিনেমার শেষ দিকের শূন্যদৃষ্টি মাছটি এই স্মৃতি থেকেই উঠে আসা)। ১৯৩৭ সালে প্রতিকৃতি বিক্রির দোকান 'ফেবো' খুললেন। মিলানের পত্রিকা দোমেনিকা দেল কুরিয়েরে প্রথম রসাত্মক রচনা প্রকাশিত হলো: ‘পোস্টকার্ডস টু আওয়ার রিডার্স’। পরের বছর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী ও কৌতুক রচয়িতা হবেন। এলেন মিলানে। সাপ্তাহিক ‘৪২০’ পত্রিকায় প্রথম কার্টুন বেরোলো।

শুটিংয়ে মশগুল ফেদেরিকো ফেলিনি

ফেলিনি স্কুল জিনিসটায় মজা পাননি। এক বছরে ৩৭ দিন অনুপস্থিত থাকার রেকর্ড ছিলো। গ্রাজুয়েশনের পর ১৯৩৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ রোমের ল স্কুলে ভর্তি হলেন। জীবনীপ্রণেতা হোলিস এপার্ট জানাচ্ছেন, একদিনও ক্লাস করবার রেকর্ড নেই। চিত্রশিল্পী রেনাল্ডো গেলেং আর ফেলিনি বন্ধু হলেন। দুই বন্ধুতে মিলে  রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফের পৃষ্ঠপোষকদের মুন্ডু আঁকতেন।  দরিদ্র ছিলেন দুই বন্ধু। দ্বিসাপ্তাহিক মার্কঅরেলিও পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখকের কাজ পেলেন ফেলিনি, নানা পত্রিকা ঘুরে। নিয়মিত কলামের নাম : ‘বাট আর ইউ লিসেনিং?’  ১৯৩৯-১৯৪২ এই কয়েক বছর স্থিতিশীল উপার্জন ছিলো। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে পরিচয় হলো, পরের জীবনের যাদের সাথে কাজ করবেন তিনি। এতোরে স্কলা, সেজারে জাভাত্তিনি, বেরনার্দো জাপ্পোনি- এই মানুষগুলোকে পেলেন মার্কঅরেলিও পত্রিকায় কাজের সূত্রে। সিনে-ম্যাগাজিনোর জন্য ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত বিচিত্রানুষ্ঠানের পারফর্মার আলদো ফ্যাবরিজির সাক্ষাৎকার নিতে গেলেন, বন্ধুত্ব হলো সারাজীবনের, পরস্পরকে সাহায্য করতেন নানাভাবে। মারিও মাতোলির ফিল্ম 'ইল পাইরাটা সোনো ইও'-তে প্রথম স্ক্রিন ক্রেডিট পেলেন, ফ্যাবরিজির সাহায্যেই।

১৯৪০ সালের ১০ জুন ফ্রান্স আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে চিৎকার দিলেন মুসোলিনি, ১৯৪৩ সালে ২৫ জুলাই পতন ঘটবে তাঁর- মাঝখানের সময়ে প্রচুর পড়াশোনা ও প্রেম হলো, লেখালেখি আর অল্প সিনেমা পরিচালনাও। কাফকা, গোগল, জন স্টেইনবেক, ফকনারের লেখাপত্রের সাথে পরিচয় ঘটলো আর ফরাসী সিনেমার দুই দিকপাল মারসেল কার্নে আর রেনে ক্লেয়ারের কাজের সাথে ঘনিষ্ঠতা হলো। চুয়াত্তর পৃষ্ঠার এক পুস্তিকা প্রকাশ করলেন : 'দ্য এবসার্ড এডভেঞ্চার্স অফ পাস্কোয়ালিনো'।  ১৯৪২ সালের হেমন্তে, ইতালির পাবলিক রেডিও ব্রডকাস্টারের অফিসে হবু স্ত্রীর সাথে দেখা। জুলিয়েত্তা মাজিনা তখন রেডিও ধারাবাহিক কিকো আর পলিনাতে পলিনার কণ্ঠ দিচ্ছিলেন। সে বিধ্বস্ত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পলিনার এই কন্ঠ সমাদর পেয়েছিলো। আমরা বরং এখন জুলিয়েত্তার সাথে পরিচিত হই কেননা ফেলিনির ১৯৪২ পরবর্তী জীবনে এই ভদ্রমহিলাই সবচেয়ে বড় প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রেখেছেন, মনোসমীক্ষক কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং আর ছেলেবেলার স্মৃতি বাদ দিলে।

১৯২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, জুলিয়েত্তা আনা মাজিনা ছোট্ট সান জর্জিও ডি পিয়ানো শহরে জন্মান এক শিক্ষক পরিবারে, চার ভাইবোনের সবার বড়ো তিনি। শৈশব থেকেই থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট তিনি মিউজিক নিয়ে পড়াশোনায় স্নাতক হয়ে পিয়ানোবাদক হতে কাকীর সাথে চললেন রোমে। পরে মন পাল্টে আধুনিক সাহিত্য পড়তে ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার সময়েও মঞ্চের প্রতি ভালোবাসা বাদ দেননি । নিয়মিত প্লাউত আর গোলদোনির নাটকের অপেশাদার প্রযোজনায় সময় দিতেন। এক প্রযোজনায় তরুণী দৃষ্টি কাড়লেন বিশিষ্ট এক মঞ্চ পরিচালকের, তিনি কুইরিনো থিয়েটারে আমন্ত্রণ জানালেন, গেলেন মাজিনা। কিন্তু উচ্চারণে উত্তরের টান এড়াতে কাজ নিলেন রেডিওতে,  সেখানে কিকো আর পলিনার রোমাঞ্চ অভিযানে কণ্ঠ দিতেন, এই ধারাবাহিক ফেলিনিপ্রণীত। ঐ সময় ফেলিনি ছোট্ট এক সংবাদপত্রে কার্টুন আঁকতেন আর প্রাণপণে এড়াতে চাইছিলেন মুসোলিনির সৈন্যবাহিনিতে যোগ দেয়ার বিষয়টি। ফিল্ম স্টুডিওর জন্য ‘মোরালদো ইন দ্য সিটি’ চিত্রনাট্য লিখলেন, না হওয়া এই ফিল্ম প্রেম বিষয়ে আলাপ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু স্টুডিওর মালিক ফ্যাসিস্টের ছেলে, ফিল্ম হলো না তাই। একটি ফটোগ্রাফকে কেন্দ্র করে দুজনের পরিচয়- জুলিয়েত্তা আর ফেলিনির। রেস্টুরেন্টে দেখা হলো তাঁদের। ‘ফেদেরিকোর বাড়তি কোনো আবেগ দেখা যায়নি আমার প্রতি,’ জুলিয়েত্তা বলছিলেন পরে, ‘একজন বন্ধুপ্রবণ তরুণ, এইমাত্র।’ খেয়েদেয়ে ঘরে ফেরাÑ জুলিয়েত্তা ডেট করতে চাইলেনÑ যখন ফেলিনি অর্ডার দেয়া শেষ করলেন চারপাশের বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র দেখে জুলিয়েত্তা ভাবছিলেন, তাঁর সঙ্গী পাগল হয়ে গেছেন, ভাবছিলেন ফেলিনির চা খাওয়ার পয়সাও নেই। যখন বিল দেয়া হলো তরুণ যুগলকে, ফেলিনি সানন্দে টাকার তোড়া বের করলেন। ফেলিনিকে এতো পয়সা সহ আগে কখনো দেখা যায়নি।

ফেলিনির সাথে জুলিয়েত্তা মাজিনা

১৯৪২ সালের নভেম্বরে ফ্যাসিস্ট ইতালি অধিকৃত লিবিয়া গেলেন ‘নাইট অফ দ্য ডেজার্ট’ ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখতে, ওসভালদো ভালেন্সি আর জিনো টালামোর ছবি, প্রথম দৃশ্যটি পরিচালনা করতে হয়েছিলো তাঁকে। ত্রিপোলীর পতন ঘটলো ব্রিটিশ বাহিনির তৎপরতায়, ফেলিনিরা সামান্যের জন্য পালাতে পারলেন, পরে মার্কঅরেলিও পত্রিকায় ‘দ্য ফার্স্ট ফ্লাইট’ নিয়ে লিখলেন। মিত্রবাহিনীর বিমান মহড়া  বোলোগনায় তাঁর সব মেডিক্যাল রেকর্ড ধ্বংস করলে 'অরাজনৈতিক' ফেলিনি বেঁচে যান।

তো, মুসোলিনির পতনের আগ পর্যন্ত জুলিয়েত্তার কাকীর বাড়ি লুকিয়ে ছিলেন এই যুগল, নয় মাস ধরে প্রেমের পর ত্রিশে অক্টোবর বিয়ে করেন, বিয়ের সাত মাস পর গর্ভস্রাব। ২২ মার্চ ১৯৪৫ পিয়ের ফেদেরিকো জন্মালো আর পরের মাসের চব্বিশ তারিখ এনকেফেলাইটিসে চলে গেলো।  ১৯৪৪ সালে এনরিকো ডি সেটার সাথে ‘ফানি ফেস শপ’ খুলে কোনোমতে চলছিলেন ফেলিনি।

রবের্তো রোসেলিনির ফিল্ম ‘রোম, ওপেন সিটি’ আর ‘পাইসা’র চিত্রনাট্য লিখলেন। ইতিহাসের অংশ হওয়া সবে শুরু। যথাক্রমে ১৯৪৫ আর ১৯৪৬ সালে মুক্তি। দুবারই অস্কার নমিনেশন চিত্রনাট্যকার হিসেবে বাকি দুজনের সাথে।  অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালে আলবের্তো লাত্তুয়াদার ফিল্ম ‘উইদাউট পিটি’তে সরলমনা দেহপসারিণী মারসেলার চরিত্রে অভিনয় করে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টে সাপোর্টিং রোলে প্রথমবারের মতো সিলভার রিবন পান জুলিয়েত্তা মাজিনা।

১৯৫০, ফেলিনির উদ্বোধনী সিনেমা 'ভ্যারাইটি লাইটস' যার সহযোগী নির্মাতা ছিলেন আলবের্তো লাত্তুয়াদা, অভিনয় করে আরেকবার সিলভার রিবন পান জুলিয়েত্তা মাজিনা। সবার ভালোবাসা পেলেন তিনি। সিনেমাটিতে লাত্তুয়াদার স্ত্রীও ছিলেন। এখানে একজন মাঝবয়সী মানুষ,  চেকোকে দেখা যায়, তিনি সব সময় সব উৎপাত থেকে লিলিয়ানাকে রক্ষা করতে চান। রাস্তায় একজন শিল্পীর সাথে দেখা হয় চেকো'র। কথোপকথনটি এমন :

- এখানে, শিল্পীদের জন্য খারাপ সময়। তুমি, একজন শিল্পী?

- চেকো দেল মন্তে, কোম্পানি বস

- আমার সাথে চলো

- তুমি কোথায় থাকো?

- রোম আমার বাড়ি। সব রাস্তা, সব রাস্তার মোড় আমার। আমি তোমার মতোই বাস্তুহারা। 

এই মানুষটি ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, সঙ্গীত ভালোবেসে ইতালি চলে এসেছেন, এখন গৃহহীন। আবার উইলমা, নারী গিটারিস্টের উচ্চারণ : ‘আমি তোমার বেদনার পাশে থাকবো। আমি জীবনের পরোয়া করি না।’

‘বাকি ইতালির মতো তুমি একটা পা-ও তুলতে পারছো না?’ এমন শ্লেষগভীর সংলাপ ছিলো সিনেমাটিতে, শুরু থেকেই রাজনৈতিক ফেলিনি, পরোক্ষে হলেও।

ইতালিতে তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় কার্টুন স্ট্রিপ ছিলো ফোটোরোমানজি। মিকেলাঞ্জেলো আন্তনিওনি প্রথম লেখেন ১৯৪৯ সালে 'দ্য হোয়াইট শেখ' চলচ্চিত্রের গল্প, ঐ কার্টুন স্ট্রিপ অবলম্বনে। প্রযোজক কার্লো পন্টি ফেলিনি আর তুলিও পিনেলিকে লেখার বরাত দিলেন। কিন্তু তাঁদের তৈরি করা গল্প আন্তনিওনি বাতিল করলেন। এনিও ফ্লাইয়ানোর সাথে গল্পটা আবার সাজালেন ফেলিনি। গল্পটা নতুন বিবাহিত যুগল ইভান আর ওয়ান্ডাকে কেন্দ্র করে ঘোরে। ইভান সরলসোজা ছেলে আর ওয়ান্ডাও ভালো মেয়ে, কিন্তু, আজকালকার ভাষায় ‘ক্রাশ’ খেয়েছে স্থিরচিত্র নির্ভর ধারাবাহিকের নায়ক হোয়াইট শেখের পৌরুষের সৌন্দর্যে। তাই পরিবারকে বউ দেখাতে রোম এলে, বউ পালালো ইভানের, পালিয়ে এলো সে-ই পত্রিকা অফিসে যেখানে হোয়াইট শেখের ধারাবাহিক আবির্ভাব ঘটে। পরিচয়ও হলো নায়কের সাথে। শুটিং পার্টিতে গিয়ে একা হয়ে গেলো তরুণী। কী যে অসহায়, কপর্দকহীন। রোম থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে এক ক্রীড়ারত শিশুকে ওয়ান্ডা বলতে থাকে,  ‘ওগো শিশু,  তুমি কি জানো এখানে কোথায় টেলিফোন করা যায়?’, তখন চারদিকে কাশফুল। মজার দৃশ্যও আছে অবশ্য। স্যান্ডো গেঞ্জি ও বুক পর্যন্ত উঠে আসা কালো জাঙিয়া পরা এক মোটা লোককে শুটিংয়ের পরিচালক বললেন,  ‘এখানে আপনি কি করছেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘মাফ করবেন আমি  লাইনের দশ নম্বর চিত্তবিনোদিনীর স্তাবক।’ নানা ঘটনাক্রম শেষে মধুর মিলন। ছবিটি কানে ওরসন ওয়েলসের ‘ওথেলো’র সাথে লড়াই করেছিলো। ভেনিসেও দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু এক ক্রিটিক বললেন, ছবিটাতে বড্ড ফুটবল খেলার আবহ। আরেকজন বললেন, এই পরিচালক দিয়ে কাজ হবে না। সে সিনেমা কি জিনিস জানে না। সিনেমাটি ফেলিনি আর লাত্তুয়াদাকে ঋণের সাগরে ডুবিয়ে দিলো।

ইতিহাসের দেবতা তখন হাসছিলেন মৃদু।

‘আই ভিতেলনি’ (১৯৫৩) ফেলিনির তিন নম্বর সিনেমা। পাঁচ যুবকের গল্প। অ্যালবের্তো, লিওপোলদো, মোরালদো, ফাউস্তো আর রিকার্ডো। তিপান্ন সালের সুন্দরী প্রতিযোগিতার ‘মিস সাইরেন’ সব সম্ভাবনা পায়ে ঠেলে সংসারী হয়ে পড়লো, কিন্তু তাঁর স্বামী ফাউস্তো মোরেত্তি সংসারে অমনোযোগী, চোর এমনকি লম্পট। একটি চরিত্র বলে, ‘আমি সোসালিস্ট’, তার উত্তরটি এমন: ' সোসালিস্ট? তুমি তো মানুষই নও।’ লিওপোলদো নাটকের মধ্যেই ডুবে থাকে, আশা একদিন নাম করবে। আর মোরালদো এই ছোট সমুদ্র উপকূলের শহরে আর নিজেকে আঁটাতে পারছে না। ‘যে আত্মা নষ্ট হয়ে গেছে অহংকার তার আর কি ক্ষতি করতে পারে? আমার বন্ধুরা আমাকে বোঝে না। তারা তাদের বাস্তব একঘেঁয়ে জীবনে বাস করে, মেয়েমানুষ আর টাকাপয়সার বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। আমি একা বোধ করি।’ আরেক চরিত্রের চিৎকার। ফেলিনির ভাই রিকার্ডো এই চলচ্চিত্রের অভিনেতা ছিলেন। আর সমালোচকেরা বলেন, মোরালদো চরিত্রটিতে ফেলিনির ছায়া আছে। এই সিনেমা ফেলিনির পায়ের নিচে মাটি শক্ত করলো।

১৯৫৩ সালে ছয়জন পরিচালকের এক এন্থোলজি ফিল্ম মুক্তি পায়। এখানে অংশ নেন কার্লো লিজ্জানি, মিকেলাঞ্জেলো আন্তনিওনি, দিনো রিসো, ফেদেরিকো ফেলিনি, ফ্রান্সেসকো মাসেলি এবং সেজারে জাভাত্তিনি, আলবের্তো লাত্তুয়াদা। এখানে ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন পরিচালকেরা। ফেলিনির অংশটি দুঃখ ভারাতুর। একটি মেয়ে ম্যারেজ এজেন্সির ডাক পেয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসে। সম্ভাব্য বরের বন্ধু ইন্টারভিউ নেয়। বলতে থাকে বন্ধু সম্পর্কে। ওলেভানো শহরে নয় ভাইবোন নিয়ে থাকা এক মেয়ে, ভাইয়ের জন্য একটি সিগারেট নেয়। বন্ধুটি চন্দ্রগ্রস্ত রাতে নেকড়েমানব হয়ে যায়, ডাক্তারেরা বলেছেন বিরল অসুখ, এমনিতে বনেদী পরিবার, সুখ সুবিধে অঢেল। মেয়েটির এতে আপত্তি নেই জানায়, বরং অসুস্থ লোকটির জন্য সমবেদনা জানায়, এক সময়ে বলে, জানেন আমি তিন দিন না খেয়েছিলাম, পরে এক পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটি দেখে আবেদন করি। না, নিয়তি যার বিপক্ষে পরিচালক তাকে দয়া দেখান কেমন করে! মেয়েটিকে বন্ধু অফিসের সামনের রাস্তায় নামিয়ে দেয়। সিনেমা শেষ হয়। ছোট, ষোল মিনিটের এই সাদাকালো চলচ্চিত্র দেখা শেষে সে অভুক্ত দরিদ্র মেয়েটির জন্য আমাদের সারা অস্তিত্ব সজল হয়ে ওঠে।

‘লা স্ত্রাদা’র সেটে ফেলিনি

লা স্ত্রাদা (১৯৫৪), ফেলিনির পাশাপাশি নিনো রোতার এক অনবদ্য সৃষ্টি। ফেলিনির সাথে পরিচয়ের সময়েই  নিনো প্রায় নব্বইটি সিনেমার সুর করে ফেলেছিলেন, ‘দ্য হোয়াইট শেখ’ আর ‘আই ভিতেলিওনি’ তো আছেই, চল্লিশ দশকের শুরুর দিকে কেরিয়ার শুরু হয়েছিলো তাঁর, তবে দৃষ্টি আকর্ষণ সুরকার হিসেবে ‘লা স্ত্রাদা’ দিয়ে। চলচ্চিত্রে আগ্রহীরা জানেন, রোমের চিনেচিত্তা ১৯৩৭ সালে বেনিতো মুসোলিনির তৈরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আর পরে আবার সংস্কার কাজ শেষ হলে পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা আর ইউরোপের ফিল্মের প্রধান স্টুডিওতে পরিণত হয়। ফেলিনি স্মৃতিচারণ করছিলেন নিনো রোতার সাথে প্রথম সাক্ষাতের : ‘চিনেচিত্তার বাইরে, আমি এক মজাদার ছোটখাটো মানুষকে আবিষ্কার করলাম একদিন, ট্রামের জন্য ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো, চারপাশে যা দেখছেন, তা নিয়ে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। আমার মনে হলো,  তাঁর সাথে অপেক্ষা করি খানিক। আমি নিশ্চিত ছিলাম, ট্রাম তার নিজের নিয়মিত জায়গাতেই থামবে, আমাদের ট্রাম ধরতে দৌঁড়াতে হবে আর তিনি একইভাবে নিশ্চিত ছিলেন, তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছেন, ট্রাম সেখানেই থামবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে, ট্রাম ঠিক আমাদের সামনে থামলো।’ শুরু হলো চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা যুগলবন্দীর। ‘দ্য হোয়াইট শেখ’ থেকে ‘অর্কেস্ট্রা রিহার্সাল’ পর্যন্ত, সব সিনেমার সুরকার নিনো রোতা, মৃত্যু তাঁকে নিয়ে না গেলে আমরা অন্তত নিশ্চিত ফেলিনির বাকি সিনেমার সঙ্গীত তাঁকেই করতে হতো। ‘লা স্ত্রাদা’র গল্পটি জাম্পানো আর জেলসোমিনার। আমেরিকান কার্টুনিস্ট ফ্রেডারিক বার উপারের হ্যাপি হুলিগান পড়েছিলেন স্কুলবেলায়, খানিকটা তার আদলেই গড়ে উঠলো জেলসোমিনা, দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, কিনে নিয়ে আসে জাম্পানো কিছু পয়সা দিয়ে। জেলসোমিনা কিন্তু সারাজীবন ভালোবাসাটুকু পেলো না। দুজনে মিলে সার্কাসের খেলা দেখায়। খাওয়ায় পরায়, এইটুকুই। একদিন অসুস্থ মেয়েটিকে ফেলে পালায় জাম্পানো। জানতে চেয়েছিলো জেলসোমিনা, ‘জাম্পানো, আমি মারা গেলে তুমি কাঁদবে?’ অনেকদিন পর ট্রাম্পেটের পরিচিত সুরে জাম্পানো উৎস জানতে গিয়ে জানলো, জেলসোমিনা এই মিথ্যেবাদী পালিয়ে যাওয়া মানুষের পৃথিবীতে নেই। মারা গেছে সে। সিনেমা শেষ হয়, সমুদ্রসৈকতে জাম্পানোর সর্বস্বহারা হয়ে কান্নার দৃশ্যে। আমরা বুঝে নিতে পারি, সর্বস্বহারা সর্বহারার চেয়েও নিঃস্ব অবস্থা, কেন না সর্বহারার তাও সম্ভাব্য ভালোবাসার মানুষটি থাকে। ‘লা স্ত্রাদা’র সময় ফেলিনি প্রথমবার ভয়াবহ বিষণ্নতায় ডুবে যান। তখন ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষক এমিলিও সারভেদিও ফেলিনির মনের দায়িত্ব নেন।

কার্লো একজন চিত্রকর, চিত্রপ্রদর্শনীর স্বপ্নে বিভোর। বিদোনে কন্যা প্যাট্রিজিয়ার সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে ফুল কিনে দেয়। রবের্তো, রিনাল্ডো এরাও বিদোনে আর কার্লোর মতোই প্রতারক, নানাভাবে প্রতারণা করেই তাদের চলে।  কবর থেকে কংকাল তুলে নকল সোনা দিয়ে ধর্মের নামে টাকা আদায়, বাড়ি দেবার নাম করে টাকা হাপিস, তেলের ডিপোতে কম দামি কোট দিয়ে টাকা মেরে দেয়া এসব করেই চলছিলো তাঁরা। একটি পঙ্গু মেয়ে বিদোনেকে পাল্টে দিয়েছিলো। সে জীবনের জন্য পঙ্গু তবু কারো প্রতি অভিযোগ নেই, মানুষকে বিশ্বাস করতে চায়। বিদোনের কোনো উজ্জ্বল উদ্ধার নেই। পরিত্যক্ত অবস্থায় মৃত্যুই তার নিয়তি। ‘ইল বিদোনে’ (১৯৫৫) একটি মানবিক চলচ্চিত্র। প্রতারকের অন্ধকারের ভেতরেও যৎকিঞ্চিৎ আলোসন্ধানী এই সিনেমা। ‘ইল বিদোনে’র জন্য হামফ্রে বোগার্টকে ভাবা হয়েছিলো। ফুসফুসে ক্যান্সার থাকায় তাঁর বদলে এলেন ব্রোডেরিক ক্রফোর্ড, ‘অল দ্য কিংস মেন’ সিনেমার পোস্টারে ব্রোডেরিককে দেখে ফেলিনির ভালো লাগে। দুঃখের বিষয়, ১৯৬৪ সালে পর্যন্ত চলচ্চিত্রটি কোনো আন্তর্জাতিক পরিবেশক পায়নি।

বসন্ত, ১৯৫৬। ‘নাইটস অফ ক্যাবিরিয়া’র প্রস্তুতিকালে বাষট্টি বছর বয়সী বাবার মৃত্যুসংবাদ পান ফেলিনি। ‘ইল বিদোনে’র সেটে এক নারীর দেখা পেয়েছিলেন, শরীর বিক্রি যার জীবিকা। কিন্তু সারা ইতালিতে কেউ প্রধান চরিত্র দেহজীবীর এমন ছবিতে বিনিয়োগে রাজী হচ্ছিলো না। অবশেষে পেলেন। ইতিহাস নির্মিত হলো। ক্যাবিরিয়া, সারাজীবন ঠকে যাওয়া এক নারী। নিজেকে বিক্রি করে তার যে সঞ্চয় সেইটুকু সম্বল করে চেয়েছিলো ভালোবাসতে, আবারো প্রতারণার শিকার হলো। কিন্তু ফেলিনি অনন্য এইখানেই, ক্যাবিরিয়া এতোকিছুর পরও হাসতে পেরেছিলো, চোখে জল নিয়েও হাসতে পেরেছিলো। টানা দুইবার বিদেশী ভাষা ক্যাটাগরিতে অস্কার পেলেন ফেলিনি।

‘লা ডলচে ভিতা’, ১৯৬০ সালের সিনেমা এক নতুন যৌথতার ইতিহাস। মার্চেলো মাস্ত্রইয়ানি এবং ফেলিনি। প্রযোজক চেয়েছিলেন, পল নিউম্যানকে। রীতিমত জোর করেই তরুণ মাস্ত্রইয়ানিকে নিলেন ফেলিনি আর অনিতা একবারি। নয়া বাস্তববাদ নিয়ে ফেলিনির এক মন্তব্য পাই আমরা, নায়িকাকে করা প্রশ্নে: ‘ডু ইউ থিংক ইতালিয়ান নিওরিয়েলিজম ইজ ডেড অর এলাইভ?’  এখানে মার্চেলো একজন তরুণ বিনোদন সাংবাদিক যে এখনো করে উঠতে পারেনি কিছু, ঘরে নানা রোগে ভারাক্রান্ত বাগদত্তা। চলচ্চিত্রটি ঝলমলে। তৎকালীন ইতালীয় বিনোদন দুনিয়ার খানিকটা দেখা যায় ফেলিনির চোখ দিয়ে। আমাদের এই পরিচালক সে অর্থে ধার্মিক নন। সেই ‘ইল বিদোনে’ সিনেমায় আমরা পাদ্রীর পোশাক পরা ভণ্ডদের দেখি, ‘নাইটস অফ ক্যাবিরিয়া’তেও গির্জার অভ্যন্তরে নানা গালভারী প্রার্থনা শুনি যা আসলে পূর্ণ হওয়ার বাস্তবতা নেই। চলচ্চিত্র সাংবাদিক ফিলিপ কেম্প যেমন বলেন, ‘যদি সার্কাসকে কখনো কখনো ফেলিনির ধর্ম বলে মনে হয়, ধর্মও তবে প্রায়শই সার্কাসের মতোই বিদ্রুপাত্মক।’  ‘লা ডলচে ভিতা’য় তিনটে বাচ্চা দেখা যায়, যারা ম্যাডোনাকে দেখেছে। তা নিয়ে গজিয়ে ওঠে কার্নিভাল পরিবেশ। প্রাচ্যের রমণী বিষয়ক বক্তৃতাটি রসাত্মক। একটি চরিত্র চেয়েছিলো, ‘আমিও ঘুরে বেড়াতে চাই আর সকল জাতির নারীর সাথে মিলিত হতে চাই। প্রত্যেক রঙের বাচ্চা চাই আমার। লাল, হলুদ, ফুলের গোছার মত।’ এই এক সংলাপে চলচ্চিত্রের বর্ণময়তা উপলব্ধি হয় আমাদের। অসংখ্য পরস্পরবিরোধী আলোচনা হয়েছে চলচ্চিত্রটি নিয়ে। শুরুতে খ্রিস্ট মূর্তি হেলিকপ্টারে উড়ে আসার দৃশ্যটি আমার মনে হয়েছে ফেলিনির একটা স্টেটমেন্ট, দেখো আমাদের বিশ্বাস আমরা উপড়ে ফেলছি হয়তো, তবু তাঁর মঙ্গল দৃষ্টি আমাদের সকল তৎপরতার উপর দিয়ে বয়ে যাবে। সেই বিখ্যাত ঝর্ণা স্নান ও সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রটি প্রবল বিতর্কের জন্ম দেয়। ধর্মের রক্ষাকর্তাদের একাংশ ক্ষেপে ওঠেন। তাঁদের উত্তর দিতে, প্রথম রঙিন সিনেমার বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন, বিজ্ঞাপনী সভ্যতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া। ‘লা ডলচে ভিতা’ বক্স অফিসের সকল রেকর্ড ভাঙার পর ফেলিনি তৈরি হলেন ধর্মের পন্ডিতদের একটি শৈল্পিক উত্তর দিতে। এ সময় তিনি কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের রচনাসমূহের সাথে পরিচিত হন। নিজের স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতে শুরু করেন। তো, ‘বোকাচ্চিও '৭০’ - এন্থোলজি ফিল্মে ফেলিনি তাঁর অংশের ছোট সিনেমায় আক্রমণ করলেন সেইসব মানুষদের, যারা ধর্মীয় নানান দড়ির গিট্টুতে শিল্পকে বাঁধতে চায়। এখানে একজন নীতিবাগীশ মানুষকে দেখা যায় যিনি তার জানালার সামনের মাঠে তরল দুধের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড দেখে ক্ষিপ্ত। সম্ভাব্য সকল উপায়েই তিনি তা নামাতে চান, ইতালির প্রথম বয় স্কাউট তিনি স্বভাবতই নীতিবান। এক সময় এতোই মগ্ন হয়ে যান তিনি যে স্বপ্নে ও জাগরণে এই বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনের নারী অনিতা একবারি তাঁকে আক্রান্ত করে। এখানে ইয়ুং উদ্ভাবিত ‘স্বপ্নপ্রতীকে’র একাধিক নিদর্শন আমাদের চোখে পড়ে। শিল্প ও শিল্প সম্পর্কিত নৈতিকতার প্রশ্ন এই ছোট ছবিতে  উজ্জ্বল ও বহুরঙা। সকল প্রকার নীতিবাগীশ মনোভাব অনিতা ফেলিনির হয়ে ফাটিয়ে দেন তাঁর উদ্বেল যৌবনের বহুমাত্রিক ব্যবহরে। আমাদের ভাবতে ইচ্ছে করে, বেদনার বিপুল বিস্তারকে সাদাকালোতে ধরে এমন একটি স্যাটায়ারের জন্য রঙ কেন বেছে নিলেন তিনি! 

মাস্ত্রইয়ানির সাথে দ্বিতীয় কাজ ‘এইট এন্ড হাফ’ (১৯৬৩), উদ্বোধনী দৃশ্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সেরা শুরু হিসেবে বহুকাল ধরেই কিংবদন্তী। একজন চিত্রপরিচালক নিজেকে ফিরে পাচ্ছেন না, চলচ্চিত্রের বিষয় এটিই। এখন, সত্য এই, এর চেয়ে অধিক আত্মজৈবনিক ও মনের জটিলতার সিনেমা ফেলিনির নেই বললেই চলে। এমনকি মাস্ত্রইয়ানির চুল রূপোলি করা হয়েছিলো, মাথায় ফেলিনিধরণের হ্যাট পরেছিলেন, ফেলিনি নিজের একটা ইমেজ নির্মাণ করতেই চাইছিলেন। না পারা থেকে শিল্পসৃজন এই প্রথম ঘটলো ইতিহাসে। পরিচালকের সত্যিকারের মানসিক জটিলতা ও তজ্জনিত ব্যর্থতার অনুভব দুনিয়ার তাবৎ ব্যর্থ সৃজনশীলের শেখার ইশকুল হয়ে উঠলো এভাবে।

‘জুলিয়েট অফ দ্য স্পিরিটস’, ১৯৬৫ সালের নির্মাণ। ফেলিনির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন চলচ্চিত্র। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই নির্মাণটি আজীবনযাপনের সঙ্গী জুলিয়েত্তা মাজিনাকে উৎসর্গীকৃত এক প্রকল্প। স্বপ্ন ও স্বপ্নসম্পর্কিত ইয়ুংপ্রভাবিত ভাবনা এই সিনেমার বড় বিষয়। একজন নারী টের পেলেন তাঁর স্বামী পরকীয়া করছেন, এখন কি করণীয় তাঁর? এই প্রথম ফেলিনির সিনেমায় ভারতীয় যাদুনির্ভর ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা বিষয় হিসেবে এলো। আসেন একজন হাস্যোজ্জ্বল, যুক্তিমান বৃদ্ধ, প্রতারিত নারীর ছেলেবেলার সঙ্গী, পরমাত্মীয়। ‘নাইটস অফ ক্যাবিরিয়া’র অনেকদিন পর, পরপর অনেকগুলো দরিদ্র নারীর চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্ব মাতানোর পর প্রথমবার ধনাঢ্য নারী চরিত্রেও মাজিনা নিজের অভিনয়যোগ্যতায় এতোটুকু বেমানান হলেন না।

‘স্পিরিটস অফ দ্য ডেড’, ১৯৬৮ সালের এন্থোলজি ফিল্ম।  এই ‘সংগ্রহ’ বিশ্ব রোমাঞ্চ গল্পের অতুল ঈশ্বর এডগার এলান পো’র কয়েকটি রচনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানে একটি ছোট ছবি, ফেলিনির, রঙিন, ছবির নাম ‘টোবি ড্যামিট’। বিশ্ব চিত্রকলার নানা রেফারেন্সে এই উজ্জ্বল ছোট ছবিতে একজন অভিনেতার চাঞ্চল্য, অস্থিরতা, নেশাসক্তি সত্তে¡ও তাঁর শিল্পসত্ত¡ার অনমনীয়তার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।

‘ডিরেক্টরস নোটবুকে’ ফেলিনি নির্মাণের গোপন অলিগলি আমাদের দেখার সুযোগ দেন। তথ্যচিত্রসুলভ চিত্রমালায় ফেলিনির হাসিখুশি নির্ভার পরিচালক সত্তাটিকে দেখা যায়। এই নির্ভার তখনই ঘটে যখন পরিচালক জানেন, সম্পূর্ণ পরিস্থিতি তাঁর আয়ত্তে¡। ‘স্যাটাইরিকন’ (১৯৬৯) সিনেমায় ভোগবাদী প্রাচীন রোম দেখি। একটি সংলাপ কি ভয়ানক! ‘জ্যান্ত প্রেমিককে হারানোর চেয়ে মৃত স্বামীকে ঝুলিয়ে দেয়া ভালো’ কিংবা শিল্পের গোড়ার কথা এক সংলাপে: ‘কবিরা মিথ্যে বলছেন এনকোলপিয়াস, কিন্তু অসুবিধা নেই। কবিতা বেঁচে থাকবে।’ ফেলিনি বলেছিলেন একবার, ‘অর্থপূর্ণ একটি ইমেজকে খুঁজে চলি আমি আর সিনেমার আত্মা হিসেবে সেটিকে তুলে ধরি।’ এই কথাটির সারসত্য ফেলিনির ‘স্যাটাইরিকনে’ খুঁজে পাবো আমরা।

‘আই ক্লাউনস’ (১৯৭০): ফুরিয়ে যাওয়া সার্কাসের হারিয়ে যাওয়া ক্লাউনদের শ্রদ্ধা জানাবার চেষ্টা, ডকুফিকশন।  সে-ই কোন ছেলেবেলায় সার্কাস দেখেছিলেন। তাঁর জীবনে সার্কাসের প্রতি প্রেম আর ফুরালো না। সিংহকে যিনি পোষ মানান, জার্মানে চিৎকার করে কমান্ড দেন। সে ভদ্রলোকের মতে, এই একমাত্র মানুষের ভাষা যা জন্তুরা বোঝে। ফেলিনির সিনেমায় এইভাবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন চকিত ছায়া ফেলে। ফেলিনিকে যেমন প্রাচীন যুগের একজন প্রাচীন যুগের ক্লাউন বলেন, 'না, মিস্টার ফেলিনি, ক্লাউনেরা অদৃশ্য হয়নি। কেমন করে হাসতে হয়, মানুষ আর জানে না। সারা পৃথিবীর আরেকবার ক্লাউনদের সাথে হেসে ওঠা দরকার।’

‘রোমা’ (১৯৭২) সিনেমায় তাঁর প্রথম রোম যাওয়াটিকে তিনি স্মরণ করেছেন। শুরুর দিকে আবার আমরা পলিটিক্যাল ফেলিনিকে দেখি: ‘ওহে বাচ্চারা, তোমরা কি ভাবছো? মুসোলিনির কি আসলেই গন্ধ বেরোয়?’ ‘আমারকর্দ’ (১৯৭৩) শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘আই রিমেম্বার’। ফ্যাসিস্ট ইতালিতে তিরিশের দশকে বেড়ে ওঠার গল্প। অনেক বছর আগে, ত্রিশের শেষ দিকে তরুণ সাংবাদিক হিসেবে চিনেচিত্তায় পা দিয়েছিলেন, স্টুডিও খোলার পরপরই। চিনেচিত্তার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সিনেমা হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিলো 'ইন্টারভিস্তা', এখানে সেসব স্মৃতিই ফিরে ফিরে আসবে। অথচ ফেলিনি কোনো সিনেমাকেই আত্মজৈবনিক বলে স্বীকার করেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্মৃতি আমার সিনেমাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। আমার সিনেমাকে আত্মজৈবনিক বলা অতি সরলীকরণ, বলা যায় ত্বরিৎ শ্রেণিকরণ। আমার মনে হয়, আমাকে সবকিছুই আবিষ্কার করতে হয়েছে : শৈশব, চরিত্র, স্মৃতিকাতরতা, স্বপ্ন, স্মৃতিরাশিমালা, আরেকবার তাদের মধ্য দিয়ে যেতে পারার জন্যেই এই বুদ্ধি। গল্পের হিসেব করতে গেলে, আমার সিনেমায় আত্মজৈবনিক কিছুই নেই।’

‘আই অ্যাম আ বোর্ন লায়ার’ (২০০২) তথ্যচিত্রে ফেলিনিকে বলতে দেখা যায়, “আমি একজন জন্মমিথ্যুক। এই হলো উপসংহার।” নারীকে তিনি অজানা গ্রহের সাথে তুলনা করেছেন। ভয়ের অনুভূতি  মানবসভ্যতার জন্য জরুরি ভাবতেন। ভাবতেন, অবিশ্বাস আমাদের চিন্তার দুনিয়াকে সীমিত করে আর বিশ্বাস কল্পনাপরিধিকে বাড়িয়ে দেয়। ফেলিনির প্রথম সিনেমা হওয়ার কথা ছিলো ‘দ্য ট্রিপ মাস্তোর্না’, সাদাকালো ছবি, কখনো হয়নি। ফেলিনি জানান, “মাস্তোর্না কিছু রয়ে গেছে ‘স্যাটাইরিকনে’, কিছু রয়ে গেছে ‘দ্য সিটি অফ উইমেনে’, এমনকি ‘ক্যাসানোভা’তেও।  ' মাস্তোর্না এক ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুল। সমুদ্রের নিচ থেকে তেজষ্ক্রিয় সংকেত দিয়ে চলেছে ...  এই প্রকল্প নিজের কিছু না হারিয়েই, শুদ্ধতা, নির্মাণচেহারা আর গল্প, কিছু না হারিয়েই আমার সকল সিনেমাকে সে পরিচর্যা করে গেছে। এটুকুই বলতে পারি আজ।”

‘সিটি অব উইমেন’ ছবির দৃশ্য

মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ পত্রিকার ১৯৮৫ সালের আগস্ট, পঞ্চম সংকলনে পেলাম রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো গৃহীত ফেলিনির এক সাক্ষাৎকার। প্রসঙ্গ : ফেলিনি রচিত ফিল্ম মেকিং গ্রন্থের রুশ সংস্করণ।  আলাপটি অনুবাদ করেছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। এখানে একটি চূড়ান্ত মন্তব্য রয়েছে ফেলিনির শিল্পসাধনা বিষয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, “স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিদ্বদ্বিতা করে জীবন সম্পর্কে কিছু বলার একটি চমৎকার মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা। আমার জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে শূন্য স্টুডিয়ো, যে শূন্য জায়গাকে ভরে তুলতে হবে।” ঈশ্বরের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিলেন ফেলিনি, দৈহিক মৃত্যু হয়েছিলো তাঁর, পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী ৩০ অক্টোবর, ১৯৯৩ সালের পরদিন। দু’সপ্তাহ কোমায় ছিলেন। সারা ইতালি থমকে গিয়েছিলো ফেলিনির মৃত্যুতে। সারাজীবনে পরিচালিত ছোটবড় চব্বিশটি সিনেমার চরিত্রেরা তাঁকে ঘিরেছিলো সে-ই অজ্ঞান দশায়, আমরা জানি। এক টিভি সাক্ষাৎকারে দেখি, তিনি আরো দুশো বছর সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রেমের সম্রাজ্ঞী  জুলিয়েত্তা চলে গেলেন চার মাস পরেই। জুলিয়েত্তা, ফেলিনি চলে যাওয়ার পর হাসি হারিয়ে ফেলেছিলেন। কথা কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের আদরের পিয়েরের পাশেই সমাহিত হন তাঁরা।

ফেলিনির জন্মশতবর্ষে চলচ্চিত্রের কত প্রাযুক্তিক বিকাশ ঘটলো। তাঁকে অতিক্রম করা গেলো না। এর রহস্যটি হয়তো প্রথম জীবনেই স্থির যাপনবন্ধু ও সিনেমার সহযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়ার মধ্যে নিহিত। ফেদেরিকো ফেলিনির জীবন ও কাজ থেকে নতুন নতুন অর্থ উৎসারিত হবে আরো অসংখ্য শতাব্দী ব্যাপ্ত করে, আমরা জানি। জন্মশত বার্ষিকীর শ্রদ্ধা জানাই, তৃতীয় বিশ্বের সামান্য চলচ্চিত্রপ্রেমিকের পক্ষ থেকে। এভাবেই পুঁজিবাদবিরোধী লড়াইয়ের আপাত ব্যর্থতার পর বিস্মরণবিরোধী লড়াইতে তাঁর হাত ধরে আমরা জিতে যাবো, বারবার।

প্রণাম!

 

লেখক পরিচিতি: তোমাকে বুঝিনি থিও, উদাসীনতার পাপ, বিপ্লব আনবাড়ি যায় প্রভৃতি বইয়ের রচয়িতা।